ইভিএম নিয়ে কেন এতো অনিহা বিরোধী দলগুলোর? | বিশ্লেষণ

'ইভিএম'-এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন। আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটগ্রহণে ইভিএম একটি নতুন প্রযুক্তি। ভোটগ্রহণের সময় ইলেকট্রনিক
5 min read

'ইভিএম'-এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন। আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটগ্রহণে ইভিএম একটি নতুন প্রযুক্তি। ভোটগ্রহণের সময় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বলে সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে পরিচিত। তথ্য প্রযুক্তির ভাষায় একে  ই-ভোটিং ও বলা হয়।  এই পদ্ধতি ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পরিক্ষামূলকভাবে চালু হয়। 

বর্তমানে সারা বিশ্বের মোট ১৯৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৩টি দেশের জাতীয় নির্বাচন ইভিএম পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। এর বেশিরভাগই পশ্চিমা দেশ তবে এশিয়ার মধ্যে রয়েছে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, কাজাখস্তান এবং আরব আমিরাত। প্রাথমিকভাবে ইংল্যান্ড, ইতালি, আয়ারল্যান্ড এবং জার্মানি ইভিএম ব্যবহার করে আসলেও পরবর্তীতে 'ইভিএম'-কে দুর্বল ও 'কারচুপি'র অন্যতম মাধ্যম আখ্যা দিয়ে এই পদ্ধতির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিশ্বের প্রভাবশালী উন্নত এই চারটি দেশ। 

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইভিএম প্রথম পরিচিতি পায় ১৯৯৯ সালে। ২০০৩ সালে ভারত সরকার ইভিএম শুধুমাত্র লোকসভা নির্বাচনে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।  ভারতে ইভিএম প্রচলনের কিছু বছর পরেই ২০০৭ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদ নির্বাচনে সনাতনী ধাঁচের পরিবর্তে ই-ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।তৎকালীন এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন বুয়েটের  তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট। ইভিএম এর বাংলা সংস্করণের আবিষ্কারক হলেন বুয়েটের আইসিটি বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ডঃ এস এম লুৎফর কবির। নানান নাটকীয়তার পর ২০২০ সালে ঢাকার সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মূল ধারার নির্বাচনে প্রবেশ করে ইভিএম প্রযুক্তি। 

স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম নিয়ে নানা বিরোধ জাগে। ফলসরূপ, ইভিএমকে প্রত্যাখান করেছে দেশের ক্ষমতাশীল বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপির এই বক্তব্যের সাথে যোগ দিয়েছেন দেশের অন্যান্য ৯টি দল। পূর্বে জাতীয় পার্টি ইভিএম নিয়ে নিরপেক্ষতা পালন করলেও বর্তমানে ইভিএমের উপর আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের প্রধান এই বিরোধী দল। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের বিশিষ্টজনদের মতে, নির্বাচন বানচাল ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিরোধী দলগুলোর ইভিএম প্রক্রিয়ার বিরোধীতা একটি  চক্রান্ত।

ইভিএম নিয়ে কেন এতো অনিহা বিরোধী দলগুলোর? এর পিছনে বড় কারন কি? আসুন জেনে নেওয়া যাক ইভিএমের সুবিধা ও অসুবিধা।


ইভিএম এর সুবিধাঃ

আপাতদৃষ্টটিতে ইভিএমের সুবিধার চেয়ে অসুবিধার পাল্লাই ভারী তবে এর কিছু যুগান্তকারী সুবিধাও রয়েছে। যেমন, ইভিএম একটি আধুনিক প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে সহজেই অতিদ্রুত ভোটদান করা সম্ভব এবং এতে প্রয়োজন নেই  একটুকরো কাগজও! কাগজের যেহেতু ব্যবহার নেই সুতরাং বলতে পারেন এটি পরিবেশবান্ধব একটি প্রক্রিয়া।

ইভিএম এর অসুবিধাঃ

এক সুত্রে জানা যায় যে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে সরাসরি ইভিএমের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ১২০টি দেশ। এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন বিশ্বের অনেক দেশই। ইভিএমের প্রতি এমন অনিহা কেনো- এই প্রশ্নের জবাবে ভারতের ব্রহ্মপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি দাস বলেছেন,

 ইভিএম অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রযুক্তি। এটি রক্ষণাবেক্ষণে দরকার প্রচুর অর্থ পাশাপাশি এটি ব্যবহারের জন্য দরকার দক্ষ জনবল। এশিয়া মহাদেশ অথবা দক্ষিণ এশিয়ায় এই দক্ষ জনবল পাওয়া কঠিন।  এছাড়াও ইভিএমের মাধ্যমে খুব সহজেই কারচুপি করা যায় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। 

 বাংলাদেশের প্রতিটি ইভিএমের ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে খরচ ধরা হয়েছে ৪ লাখেরও অধিক এবং এটি চালাতে কেন্দ্র অফিসারদের পারদর্শী করে তুলতে দরকার হবে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স। বর্তমানে দেশে ১৫০ আসন ইভিএম প্রযুক্তিতে পরিচালিত করার পেছনে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৮,৭১১ কোটি টাকা! অন্যদিকে, ব্যালট পেপারের ভোট তুলনামূলক ধীরগতিসম্পন্ন হলেও এটি ততটা ব্যয়বহুল নয়। ব্যালট পেপারের জন্য দরকার নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ও কেন্দ্র অফিসারদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ কোর্স।এছাড়াও বিগত বহু বছর ধরে সাধারণ মানুষ ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ায় তারাও এই প্রক্রিয়ার সাথে অভ্যস্ত। সুতরাং, বলা যাতে পারে ব্যালট পেপারের খরচ তুলনামূলক অনেক কম। 

বাংলাদেশের এক সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিস্ট বলেছেন, ইভিএম যে শুধু বিরোধী দলগুলোর জন্য সমস্যা তা নয়। আগামীতে হয়তো এটি ক্ষমতাসীন দলের জন্যও অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে কেননা ইভিএম সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড হওয়ায় এর প্রোগ্রামকে খুব সহজেই হ্যাক অথবা পরিবর্তন করা যায়। এর সিকিউরিটি কোড ব্রেক করে  অভ্যন্তরীণ  সকল ডাটা নাড়াচাড়ার মাধ্যমে যেকোনো দলকে জয়ী ঘোষণা করা যেতে পারে। ধরুন, আজ ক্ষমতাসীন দল ভোটে বিরোধী দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে কিন্তু কোনো অশুভ শক্তি এই ইভিএম প্রযুক্তির প্রধান সার্ভার হ্যাক করে তথ্য হেরফের করার মাধ্যমে বিরোধী দলকে জয়ী এবং ক্ষমতাসীন দলকে  পরাজয়ী সাব্যস্ত করতে পারে। ইভিএম ব্যবহারে ক্ষতি হতে পারে দুই পক্ষেরই। 



উপরের ইভিএম যন্ত্রটির দিকে একটু লক্ষ্য করুন। ইভিএম যন্ত্রটিতে 'ক' হতে 'জ' পর্যন্ত ৮টি সংসদ সদস্যের নির্বাচনী সংকেত বাংলা ব্যাঞ্জণবর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আপনি যদি 'ঘ' সংসদ সদস্যকে ভোট দেন তবে এটি আপনার ভোটে 'ঘ' সংসদ সদস্যকেই নির্বাচন করবে। কিন্তু যদি কোনো অশুভ শক্তির কবলে পড়ে যন্ত্রটির ভিতরকার প্রোগ্রামে কোনোরোকম পরিবর্তন করা হয় তবে আপনার দেওয়া 'ঘ' সংসদ সদস্যকে দেওয়া ভোট গিয়ে পড়বে অন্য সংসদ সদস্যের কাছে। অর্থাৎ 'ঘ' বাদে বাকি ৭টির মধ্যে যেকোনো একটিতে। ধরুন কোনো হ্যাকার এটির অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রামকে হ্যাক করে এমনভাবেই পরিবর্তন করলো যে আপনি যেই সংকেতই চাপুন না কেনো, এটি গিয়ে পড়বে 'জ' সংকেতযুক্ত সংসদ সদস্যের কাছে। এই জন্যই পশ্চিমা অনেক দেশে 'ইভিএম'-কে ব্যালটের তুলনায় দুর্বল ধরা হয়। কেননা ব্যালটে হ্যাক অথবা প্রোগ্রাম পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র গণনার কাজ হওয়ায় ব্যালটকে 'ইভিএম'-এর চেয়েও শক্তিশালী ধরা হয়। 
 
ইভিএম নিয়ে একটি প্রচলিত কাল্পনিক রম্যগল্প আছে। এক দেশের এক প্রেসিডেন্ট দেখলেন সে দেশের জনগণ বিরোধী দলকে বেশি সমর্থন করছেন।বলা যায় আসন্ন নির্বাচনে ওই প্রেসিডেন্টের হার প্রায় নিশ্চিত।তিনি অত্যন্ত চতুর ও বুদ্ধিমান হওয়ায় তিনি ইভিএমের মধ্যে কিছু জিনিস পরিবর্তন করলেন। অর্থাৎ ভোটের প্রক্রিয়াটাকেই উল্টো করে দিলেন! যে যে ব্যাক্তি বিরোধী দলীয়  প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছিলেন, তার ভোট এসে জমা হচ্ছিলো প্রেসিডেন্টের নামে এবং যে যে ব্যাক্তি প্রেসিডেন্টকে ভোট দিচ্ছিলেন, তার ভোট এসে জমা হচ্ছিলো বিরোধী দলীয় প্রার্থীর নামে! ফলাফলে দেখা গেলো, প্রেসিডেন্ট ৯০% ভোট পেয়ে জয়ী হলেন।জনগণ হলেন বেকুব , প্রেসিডেন্ট হলেন চতুর।

২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প বনাম হিলারী ক্লিনটন এর নির্বাচনে রাশিয়ান হ্যাকাররা হস্তক্ষেপ করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম নিশ্চিত করেছে। 'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস"- এর মতে নির্বাচনী সার্ভারের সিকিউরিটি কোড হ্যাক করে অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে ট্রাম্পকে অবৈধভাবে জিতিয়েছিলো রাশিয়ান হ্যাকাররা। এই নির্বাচনকে ঘিরে তৎকালীন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএম প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছিলো তবে স্বয়ং মার্কিনীরাই ইভিএমের বিরোধীতা করেন এবং অনেক স্টেটেই ইভিএমের প্রচলন নেই তবে তাদের একটি ভিন্নধর্মী নির্বাচনী প্রযুক্তি আছে।

ইভিএম একটি আধুনিক প্রযুক্তি। এতে কোনো সন্দেহ নেই তবে আমাদের আগে বুঝতে হবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কি! বিশ্বে এমন অনেক আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছিলো যা পুরাতন প্রযুক্তির সামনে একবারো টিকতে পারেনি। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। যেমনঃ কাটাযুক্ত ঘড়ি এর আবিষ্কার হয়েছিলো ১৫ থেকে ১৭শ শতকের দিকে যা এখনো পুরোদমে ডিজিটাল কাটা-বিহীন ঘড়িগুলোর সাথে টেক্কা দিয়ে চলেছে। সুতরাং বলা যায় কিছু কিছু পুরাতন প্রযুক্তিও নতুন প্রযুক্তিকে হারাতে সক্ষম।

'ইভিএম' ব্যবহার কতটা যুক্তিসম্পন্ন তা সব সময়ই বিশ্বে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কেউ বলেন এটি আধুনিক আবার কেউ বা বলেন এটি কারচুপির মাধ্যম। এখন প্রশ্ন রয়েছে আপনি কাকে অধিক গুরুত্ব দিবেন? ইভিএমকে নাকি ব্যালটকে? কমেন্ট করে জানাবেন।

You may like these posts

  • 'ইভিএম'-এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন। আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটগ্রহণে ইভিএম একটি নতুন প্রযুক্তি। ভোটগ্রহণের সময় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বলে সা…
  • 'Sri Lanka Guardian' —  A banned web newspaper recently accused of spreading misinformation about the Prime Minister of  Bangladesh. The web newspaper published a re…
  • There are numerous universities in the world today that are both privately sponsored and publicly funded. Their popularity is on the rise as well as they are often seen in QS ranki…
  •  ছবিঃ সংগৃহীতকথায় আছে "নারী মানে শক্তি, নারী মানে ক্ষমতা"। সেই উক্তিটিরই যেন বহিঃপ্রকাশ এই রুমিন ফারহানা! যদিও বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু সেটা নিয়ে বলতে চাইনা। প্রধানমন্ত…

Post a Comment